শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ, ১৪৩১
অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম।।
খাদ্যে ভেজাল একটি আলোচিত ও ভয়াবহ সমস্যা। সর্বত্রই ভেজাল মেশানোর তুমুল প্রতিযোগিতা। অথচ বেঁচে থাকার, বেড়ে ওঠার, দৈহিক পুষ্টির মানসিক বিকাশে সুষম পরিমিত নিরাপদ খাদ্যের প্রয়োজন। চাল, ডাল, লবণ, তেল, মাছ, গোশত, সবজিসহ বিভিন্ন ধরনের ফলফলাদি স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ হওয়া দরকার। বিভিন্ন ধরনের হোটেল রেস্টুরেন্ট কিংবা ফুটপাথের খাবার কোনোটি নিরাপদ নয়। বিভিন্ন ধরনের ভেজাল মেশানো ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের খাবার আমরা জেনে বা মনের অজান্তেই খাচ্ছি। একশ্রেণীর অসাধু মানুষ বেশি মুনাফার আশায় জেনেবুঝেই অস্বাস্থ্যকর খাবার তৈরি ও বিক্রি করছে। এদের তৎপরতা বন্ধে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে মাঝে মধ্যে তৎপর হতে দেখা যায়; কিন্তু তা সাময়িক। পরক্ষণেই সর্বত্র আগের অবস্থা বিরাজ করে। অথচ ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(গ)-এর ১(ঙ) ধারায় খাদ্যে ভেজাল, ওষুধ মেশালে, ভেজাল খাদ্য বা ওষুধ বিক্রি করলে কিংবা বিক্রি করার জন্য প্রদর্শন করলে অপরাধ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন বা ১৪ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবুও এ আইনের আওতায় কারো শাস্তি হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়নি। ভেজাল খাবার গ্রহণের ফলে লিভার ও কিডনি রোগের প্রাবল্য বেড়েছে। বেড়েছে ওষুধ ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়। ওষুধ ব্যবসায়ীদের মুনাফা বাড়লেও ওষুধের ভেজাল কমেনি। ফলে ওষুধ খেয়ে অসুখ সারানো দুরাশায় পরিণত হয়েছে।
ইদানীং বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের ব্যাপকতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এখানেও বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিযুক্ত খাবার জড়িয়ে রয়েছে। রোজার মাসে লিভার-কিডনির জন্য ক্ষতিকর, ঝুঁকিসম্পন্ন খাবারে বাজার সয়লাব হয়ে যায়। অথচ দেখার কেউ নেই। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও ফলপ্রসূ কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি। ফলে বিষাক্ত খাবারের প্রসার বাড়ছে। এ ব্যাপারে সরকারের প্রচেষ্টাগুলো আরো সমন্বিত ও পরিকল্পিত হওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত সময়ে নিরাপদ খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার। মাছ বা পশুপালনের খাবার নিরাপদ করতে না পারলে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। জিংক, সিসা কিংবা মাছ-মুরগির খাবারে ক্রোমিয়ামের ব্যবহারে কঠোরহস্তে দমন করা উচিত। যেসব প্রতিষ্ঠান এ ধরনের খাবার তৈরি ও বিপণন করে সেগুলো বন্ধ করা এবং জরিমানার আওতায় আনা প্রয়োজন। কারণ মাত্রাতিরিক্ত ক্রোমিয়াম ব্যবহার দুরারোগ্য ব্যাধির সৃষ্টি হয় এবং রোগীকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দেয়। শাকসবজিতে অতিরিক্ত সার এবং কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। এর কুফল সম্পর্কে কৃষকদের সচেতন করা অত্যন্ত জরুরি। মাঠপর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের এ ব্যাপারে আরো তৎপর হওয়া দরকার। কৃষকদের সাথে আলোচনা এবং তাদের সচেতন করা সময়ের দাবি। সাথে সাথে প্রয়োজন উপজেলা পর্যায়ে শক্তিশালী ল্যাবরেটরির ব্যবস্থা করা, যেন জনগণ প্রয়োজনে সহজে তাদের ক্রয়কৃত খাবারের মান যাচাই করতে পারে।
বিভিন্ন ধরনের খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হোটেল রেস্তোরাঁর মালিকদের নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য উদ্যোগী ভ‚মিকা পালন করতে হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ভোক্তা সংগঠন, বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা বাড়ানো দরকার। এটি শুধু সরকার বা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান কিংবা শুধু ভোক্তাদের একক সমস্যা নয়; এটি একটি জাতীয় সমস্যা। এর সমাধানে সবার সচেতনতা ও কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন। কৃষি, খাদ্য, পশুপালন, পরিবেশ ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত ভ‚মিকা এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি। চাল বিক্রেতা চালে, ডাল বিক্রেতা ডালে, মাছ বিক্রেতা মাছে, ওষুধ বিক্রেতা ওষুধে ভেজাল মেশাচ্ছেন। ফলে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে আমরা সবাই ভেজাল খাদ্য গ্রহণ করছি। সরকারিভাবে কিছু উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা বের করা হয়। কিন্তু এটি কয়জনের হাতে পৌঁছায় তা সহজেই অনুমেয়। এ ছাড়া নিরাপদ খাদ্য অ্যাপস রয়েছে। এই অ্যাপসের সাথে সাধারণ জনগণ তো দূরের কথা, শিক্ষিত জনগণেরও সঠিক তথ্য জানা আছে কি না সন্দেহ রয়েছে। সর্বোপরি নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার স্বার্থে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করা দরকার। অ্যাপসের ব্যবহার বাড়ানো, সহজলভ্য ও জনপ্রিয় করা দরকার।
সারা দেশে মানহীন, অবৈধ, নকল খাদ্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যে বাজার সয়লাব করলেও রাষ্ট্রীয় মান সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যার্ন্ডাডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন-বিএসটিআইয়ের তদারকির অভাবে খাদ্যে ভেজাল মেশানোর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিএসটিআইয়ের লোগো ছাপিয়ে মানহীন পণ্য বাজারজাত করা হচ্ছে। ফলে সাধারণ ভোক্তারা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। অথচ এ ব্যাপারে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের কার্যকর ভ‚মিকা চোখে পড়ছে না। রোজার মাসে পণ্যের দাম বাড়লে তাদের হইচই পড়ে যায়। এ ছাড়া অন্য ১১টি মাস তাদের তৎপরতা দেখা যায় না। এদের আরো তৎপর হওয়া উচিত। শুধু দাম কমানো নয়, খাবারটা নিরাপদ ও মানসম্মত আছে কি না সেটিও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম, ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট মিডিয়া ও সুশীল সমাজের এগিয়ে আসা দরকার।
লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ রিশেষজ্ঞ
[email protected]